হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর সংস্কারসমূহ

ইতিহস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, জগতে যত মহামানব আগমন করেছিলেন তারা সমসাময়িক বিভিন্ন ধরনের সংস্কারের মাধ্যমে কুসংস্কার বিদূরিত করে জনহিত করেছিলেন। সর্বশ্রেষ্ঠ নবি ও রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর বর্তমান অবস্থায় মানবকল্যাণের নিমিত্তে অনেক সংস্কার করেছিলেন যা বেশ ফলপ্রসূ ছিল। দীর্ঘ ২৩ বছরের নিরলস প্রচেষ্টায় বিভিন্ন সংস্কার সাধনের মাধ্যমে অনাচারে নিমজ্জিত আরব দেশে ন্যায়নীতি ও সাম্যের ভিত্তিতে একটি আদর্শ ধর্মীয়, সামাজিক ও রাষ্টীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। বহু দেব-দেবীর আরবে একেশ্বরবাদী ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করেন। রাসুল (সা.)-এর সংস্কারসমূহকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলো হলো-

  1. সামাজিক
  2. সাংস্কৃতিক
  3. রাজনৈতিক
  4. অর্থনৈতিক
  5. প্রশাসনিক

রাসুল (সা.)-এর সংস্কারসমূহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নরূপ

সামাজিক

মানবতার ভিত্তিতে সমাজ গঠন:

হজরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর প্রচারিত মতবাদে জাতি, ধর্ম কিংবা বর্ণের উর্ধ্বে মানবতাকে স্থান দিয়েছিলেন। তিঁনি ঘোষণা করেন, সব মানুষ সমান, মানুষের মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ও উৎকৃষ্ট তিনি, যিনি তাকওয়াবান। তিঁনি ‘জোর যার মুল্লুক তার’ রীতি উচ্ছেদ করেন ফলে খুন, লুণ্ঠন ইত্যাদি অপকর্ম কমে যায়। মূলত তিঁনি মানবতার ভিত্তিতে সমাজ গঠনে কাজ করেছিলেন।

সমাজে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা:

রাসুল (সা.) যখন জগতে আগমন করেছিলেন তখন ওই সমাজে নারীকে সঠিক মর্যাদা প্রদান করা হতো না। নিছক পণ্যের মতো কেনা বেচা করতো এবং তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করতো। তখন রাসুল (সা.) তাঁর অনুসারীদের নারীদের প্রতি উত্তম আচরণ করার শিক্ষা দিয়েছিলেন। তাদেরকে নারীর প্রতি সহনশীল হওয়ার শিক্ষা দিতেন।

কন্যা সন্তান হত্যা বন্ধ:

আইয়ামে জাহিলিয়া বা অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগে আরবের মানুষেরা দারিদ্র ও লজ্জার ভয়ে কন্যা সন্তানদের জীবিত পুঁতে মেরে ফেলত। রাসুল (সা.) এই প্রথা বন্ধ করতে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, “যার গৃহে কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করল, অতপর সে তাকে কষ্টও দেয়নি, তার উপর অসন্তোষ্টও হয়নি এবং পুত্র সন্তানকে প্রাধান্যও দেয়নি, তাহলে ওই কন্যার কারণে মহান আল্লাহতা’লা তাকে বেহেশতে প্রবেশ করাবেন।” (মুসনাদে আহমদ, ১:২২৩)

মক্কায় মুসলমানদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা:

মহানবী (সঃ) এর জন্মের পূর্বে আরবের অধিকাংশ লোকই ছিলো নিরক্ষর ও অশিক্ষিত। যার কারণে অল্প কিছু শিক্ষিত লোক দ্বারা তাঁরা সমাজের সবক্ষেত্রে শোষিত হতো। মক্কা বিজয়ের পর রাসুল (সঃ) সকল মুসলিম নারী পুরুষের জন্য শিক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা করলেন।

দাস-দাসীর মর্যাদা দান:

রাসুল (সা.)-এর আগমনের পূর্বে দাস-দাসীদের সাথে খারাপ ব্যবহার করত। তাদের জীবন-মৃত্যু, বিবাহ সবকিছু প্রভুর উপর নির্ভর করত। রাসুল (সা.) এসব প্রথা রদ করে তাদের সাথে ভালো আচরণ করার নির্দেশ প্রদান করেছেন। এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) বলেন, “তারা তোমদের ভাই। আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীনস্থ করেছেন। তোমরা যা খাবে তাদেরকেও তা খাওয়াবে এবং তোমরা যেমন পোশাক পরবে তাদেরকেও তা থেকে পরাবে। তোমরা তাদের উপর এমন কোনো কাজের ভার চাপিয়ে দিবে না, যা তারা করতে হিমশিম খেয়ে যায়। যদি তোমরা তাদেরকে চাপিয়ে দাও, তাহলে এ কাজে তাদের সাহায্যও করবে।” (সহিহ মুসলিম: ৪১৬৭)

সম্পদে নারীদের অধিকার:

ইসলাম পূর্ব যুগে আরবের নারীদের সম্পত্তির কোনো অধিকার ছিলো না। বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) - ই হলেন আরবের ইতিহাসে প্রথম ব্যাক্তি যিনি উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারীদের অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান করেন।

ধর্মীয় সংস্কার

একেশ্বরবাদ:

আরবে প্রচলিত বহু ইশ্বরের মতবাদ বিলুপ্ত করে এক আল্লাহর একত্ববাদের বাণী প্রচার করেন। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,“বল, তিনিই আল্লাহ এক-অদ্বিতীয়। আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন। তিঁনি কাউকে জন্ম দেননি, তাঁকেও কেউ জন্ম দেয়নি। তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই।” (সুরা- ইখলাস; ১-৪)

মসজিদে নববি প্রতিষ্ঠা:

ইসলাম ধর্মের ইতিহাসে প্রথম মসজিদ নির্মাণ করেন যা আজও মসজিদে নববি নামে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তিঁনি আজান ও প্রকাশ্যে জামাতে নামাজের ব্যবস্থা করেন।

কাবা ঘরের সংস্কার:

ইসলামের অন্যতম পবিত্র স্থান কাবা ঘর-এর সংস্কার করে মজবুত কাঠামো দান করেন ও হাজরে আসওয়াত পাথর স্থাপন করেন।

সাংস্কৃতিক

অপসংস্কৃতি পরিহার:

মদ, জুয়া প্রভৃতি কাজ নিষিদ্ধ করেন। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, “হে মুমিনগণ, নিশ্চয় মদ, জুয়া, প্রতিমা-বেদী ও ভাগ্যনির্ধারক তীরসমূহ নাপাক শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা তা পরিহার কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।” (সুরা- আল মায়িদাহ: ৯০)

সম্পীতির জাতি গঠন:

ইসলাম পূর্ব যুগে আরবের নারীদের সম্পত্তির কোনো অধিকার ছিলো না। বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) - ই হলেন আরবের ইতিহাসে প্রথম ব্যাক্তি যিনি উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারীদের অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান করেন।

রাজনৈতিক

  • মদিনা সনদ: পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান ছিল মদিনা সনদ যা রাসুল (সা.) প্রবর্তন করেন।
  • আল্লাহর আইনভিত্তিক রাষ্ট্রগঠন
  • আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা
  • সাম্যভিত্তিক সরকার গঠন

অর্থনৈতিক

  • শোষণমুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা: সুদ পরিহার ও নিষিদ্ধকরণ।
  • জাকাতের উপর গুরুত্বারোপ
  • খারাজ ও জিজিয়া: ভূমিকর ও নিরাপত্তা করের বিধান।
  • গণিমতের মালের সুষম বণ্টন: যুদ্ধ হতে প্রাপ্ত গণিমতের এক পঞ্চমাংশ মালামাল যোদ্ধাদের মাঝে বণ্টন।

বিচার বিভাগীয় সংস্কার

  • সাম্য ও ন্যায়ভিত্তিক বিচারব্যবস্থা প্রবর্তন

ঐতিহাসিক গিবন রাসুল (সা.)-এর সংস্কার সমূহকে ‘এক অতি স্মরণীয় বিপ্লব’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। পরিশেষে বলা যায় যে, রাসুল (সা.) মানবকল্যাণ করার জন্য এছাড়াও আরো অনেক সংস্কার সাধন করেছিলেন।

মন্তব্য করুন

en_USEnglish