মানবজাতির শান্তি ও মুক্তির জন্য বিভিন্ন সময়ে মহান আল্লাহ অসংখ্য নবি ও রাসুল প্রেরণ করেছেন। তাঁদের নিকট মহান আল্লাহ বার্তা প্রেরণ করে মানুষকে হেদায়েতের পথে আহ্বান করেছেন। প্রত্যেক নবি ও রাসুলকে একটি বিশেষ ঘটনার মাধ্যমে নিজ নিজ দায়িত্ব প্রেরণ করতেন। নবি ও রাসুলগণের উপর এ অর্পিত দায়িত্বই হলো নবুয়ত। আমরা প্রায়শ লক্ষ্য করে থাকি যে, পৃথিবীতে প্রত্যেকটি মহৎ কাজ একটি সুন্দর ঘটনার মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে থাকে। তন্মধ্যে কিছু ঘটনা আবার ইতিহাসেও স্থান করে নেয়। তেমনি একটি ঘটনা হলো হজরত মুহাম্মদ (সা.)- এর নবুয়ত লাভ যা ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য হয়ে আছে। ৬১০ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ শে রমজান, নবুয়ত লাভের ঘটনার মধ্য দিয়ে হজরত মুহাম্মদ (সা.) মহান আল্লাহর পক্ষ হতে ওহি বা প্রত্যাদেশ পেতে আরম্ভ করেন। এই ওহি বা প্রত্যাদেশই হলো মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মানব জাতির জন্য পথ-নির্দেশনা। ইতিহাসে রাসুল (সা.)- এর ওহি লাভের ঘটনাকে নবুয়ত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তিঁনি সাধনালব্ধ জ্ঞান দ্বারা মহান প্রভুর নিকট হতে ওহি লাভ করে তার বাহ্যিক প্রতিফলন ঘটিয়ে সারা পৃথিবীকে আলোকিত করেছিলেন।
নবুয়ত
নবুয়ত হলো নবির দায়িত্ব বা কাজ। নবুয়ত আরবি শব্দ। শব্দটি আরবি ‘নাবা’ শব্দ থেকে আগত যার মানে হলো নবিত্ব; নবির পদ; পয়গম্বর; সংবাদ দান। ইসলামি ফাউন্ডেশন অভিধান ৯০৪ পৃষ্ঠা অনুসারে এর অর্থ হচ্ছে সংবাদ, খবর, তথ্য বা রিপোর্ট ইত্যাদি। নবুয়ত শব্দটির বাংলা প্রমিত উচ্চারণ নোবুঅত্। যার ইংরেজি প্রতিশব্দ Prophecy। নবুয়ত হলো অতীন্দ্রিয় জ্ঞানের অংশ। নবুয়তের দায়িত্বকে রিসালাত বলা হয় আর যারা এই দায়িত্ব পালন করেছেন তাঁদেরকে নবি অথবা রাসুল উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে।
সাধারণভাবে বলা যায়, নবুয়ত হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে এক বা একাধিক বার্তা একজন নবি অথবা রাসুলের কাছে প্রেরণ করে তাঁর দ্বারা মানুষের নিকট পৌঁছে দেওয়া হয়।
হজরত মুহাম্মদ (সা.) - এর নবুয়ত
আল্লাহর পক্ষ থেকে ঐশী বাণী লাভ করার প্রক্রিয়াটির আনুষ্ঠানিক সূচনাকে নবুয়ত বলা হয়। বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, রাহ্মাতুল্লিল আলামিন, হজরত মুহাম্মদ (সা.) তার পুণ্য কর্ম এবং দীর্ঘদিনের ধ্যান-সাধনার মাধ্যমে ৪০ বছর বয়সে মহান আল্লাহর সন্তোষ্টি অর্জন করার পাশাপাশি নবুয়তের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। অর্থাৎ, হজরত রাসুল (সা.) মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে যখন ওহি বা প্রত্যাদেশ লাভ করার পাশাপাশি তা মানুষের নিকট পৌঁছে দেওয়ার হেদায়েতের যে মহান দায়িত্বটি লাভ করেছিলেন তাকেই রাসুল (সা.)-এর নবুয়ত বলা হয়।
হজরত রাসুল (সা.)-এর পৃথিবীতে আগমনের স্থানটি ছিল তৎকালীন আরব উপদ্বীপের অন্যতম প্রসিদ্ধ নগরী মক্কা। সময়টি ছিল ষষ্ঠ শতক (৫৭০-৬৩২ খ্রিষ্টাব্দ)। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রায় ৫৭০ বছর পূর্বে ইসলামের পূর্ববর্তী নবি হজরত ঈসা ইব্ন মারিয়াম (আ.) আগমন করেছিলেন। অর্থাৎ, মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমনের পূর্বে প্রায় ৫৩০ বৎসর পৃথিবীতে আল্লাহর মনোনীত কোন প্রতিনিধি (নবি বা রাসুল) আগমন করেননি। অর্থাৎ, দীর্ঘদিন এই পৃথিবী মহামানবশূন্য ছিল। তখন, আরব বিশ্বে কোন আদর্শ নেতা কিংবা ধর্মীয় অনুশাসন ছিল না। যে কারণে দীর্ঘদিন ওই সমাজের মানুষ মহামানবদের শিক্ষা ও সঠিক নির্দেশনা পাননি। ফলে সমগ্র আরবে এক ধরনের অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। যেমন, তৎকালীন মানুষ জীবিত কন্যা সন্তানদের পুঁতে মেরে ফেলত, নৈমিত্তিক এক গোত্র অন্য গোত্রের সাথে বিরোধে লিপ্ত থাকত, নারীদের অধিকার ও সম্পদের মালিকানা থেকে বঞ্চিত করা হতো, মদ, জুয়া ও বিভিন্ন রকমের অশ্লীলতায় নিমজ্জিত থাকত, দাসদের সাথে খারাপ ব্যবহার, ব্যভিচার ও পৌত্তলিকতা (বহু দেব-দেবীর পূজা ও বিভিন্ন ধরনের অপসংস্কৃতির চর্চা) সহ বিভিন্ন অনৈতিক কাজে জড়িত থাকত। যে কারণে আরবের ওই সময়কে ইতিহাসে ‘আইয়ামে জাহেলিয়া’ বা অন্ধকারাছন্ন যুগ বলা হয়ে থাকে। ওই সময় আরব লোকেরা বর্বর জাতি হিসেবেও পরিচিত ছিল।
এই ধরনের বহুবিধ হীন কর্মের জন্য সমগ্র আরব সমাজে শান্তি বিলুপ্তপ্রায় হওয়ার পাশাপাশি সর্বত্র অশান্তি বিরাজ করছিল। হজরত রাসুল (সা.) দেখলেন এই জাতি সদা পাপকাজে নিমজ্জিত, তবে কীভাবে তারা মুক্তি লাভ করবে? মুক্তির অন্যতম শর্ত হলো শান্তি। তাদেরকে মুক্তির দিকে ধাবিত করতে হলে প্রথমে শান্তিতে নিয়ে আসতে হবে। এহেন পরিস্থিতিতে কীভাবে এই পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় তার জন্য তিঁনি উপায় খুঁজতে থাকেন। গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে সর্বদা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য কামনা করতেন। ক্রমে দয়াল রাসুল (সা.)-এর এই গভীর চিন্তা, ধ্যান (মোরকাবা) ও সাধনার রূপ পরিগ্রহ করে। অর্থাৎ, হজরত রাসুল (সা.) যে গভীর চিন্তার মাধ্যমে সকল মানুষের শান্তি ও মুক্তির উপায় অন্বেষণ করতেন তাই ছিল ধ্যান বা মোরাকাবা।
হেরা গুহায় ধ্যান সাধনা
যৌবনে দয়াল রাসুল (সা.) নির্জনতার প্রতি অধিক আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। ক্রমে তিনি একাকিত্ব ও নির্জনতাপ্রিয় হয়ে উঠেন। ধ্যানের অন্যতম উপাদান হলো নির্জন পরিবেশ বা নির্জনতা। কিন্তু মক্কার আবাসভূমিতে ধ্যান বা মোরাকাবার অনুকূল পরিবেশ ছিল না। বিবিধ হট্টগোলের কারণে গভীর চিন্তায় (ধ্যানে) বিঘ্ন ঘটত। তাই তিঁনি ধ্যানের জন্য নির্জন স্থান হিসেবে মক্কা থেকে ৩ কি.মি. দূরে জাবালে নুর (নুর পর্বত)-এর হেরা গুহা কে নির্ধারণ করলেন। দয়াল রাসুল (সা.) তাঁর জীবনের পঁচিশ থেকে চল্লিশ (২৫-৪০) বৎসর অন্তর্বর্তী প্রত্যেকটি রমজান মাস হেরা গুহায় ধ্যান সাধনার মাধ্যমে অতিবাহিত করেন এছাড়া অন্যান্য সময় যখনই সুযোগ পেতেন তখনই সেখানে ধ্যান করার জন্য চলে যেতেন। হেরা গুহায় অবস্থানকালে তিঁনি শুকনো খাবার সরবরাহ করতেন। সেখানে ধ্যান করতে যাওয়ার সময় তিঁনি খাবার সাথে নিয়ে যেতেন। খাবার শেষ হয়ে গেলে আবার বাড়ি গিয়ে নিয়ে আসতেন। কখনো বা রাসুল (সা.)-এর স্ত্রী হজরত খাদিজা (রা.) এবং বিশ্বস্ত সাহাবি হজরত আলি (রা.) গুহায় খাবার পৌঁছে দিয়ে আসতেন। এভাবে ৫৯৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৬১০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ১৫ বছর অতিবাহিত হয়।
নবুয়ত লাভের লক্ষণ
হজরত রাসুল (সা.) হেরা গুহায় সর্বদা গভীর ধ্যান-সাধনায় নিমগ্ন থাকতেন। এভাবে বয়স যখন চল্লিশের কাছাকাছি পৌঁছালো তখন প্রায়শ ধ্যানরত ও ঘুমন্ত অবস্থায় (স্বপ্নে) অতীন্দ্রিয় বিভিন্ন বিষয় অবলোকন করতেন। এগুলো দেখে তিঁনি কখনো কখনো বিচলিতও হতেন। কেননা, তিঁনি যে স্বপ্নই দেখতেন, তা প্রভাতের রশ্মির ন্যায় স্পষ্ট প্রতিভাত হতো। এ প্রসঙ্গে হাদিসটি হজরত আয়িশা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওহি শুরু হয় ঘুমের ঘরে স্বপ্নের মাধ্যমে। তিঁনি যে স্বপ্নই দেখতেন সে স্বপ্নই ভোরের আলোর মতো উদ্ভাসিত হতো। (সহিহ্ বুখারি; হাদিস নং- ৬৯৮২)
এসব ঘটনা হজরত খাদিজা (রা.)-এর নিকট ব্যক্ত করতেন। হজরত খাদিজা (রা.) ওই সময় হজরত রাসুল (সা.)- কে সাহস যোগাতেন। যখন রাসুল (সা.) নবুয়ত লাভ করবেন তার কিছুদিন পূর্ব থেকে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর সাথে বিশেষ কিছু ঘটনা ঘটতে থাকে, যেগুলোর মাধ্যমে রাসুল (সা.)-কে নবুয়তের দায়িত্বভারের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল। যেমন: তিঁনি মাঝে মাঝে অবলোকন করতেন কোন এক ঐশী মানব তাঁর সামনে উপস্থিত হয়ে - ‘ইয়া মুহাম্মদ (সা.)! আন্তা রাসুলুল্লাহ’ অর্থাৎ, ‘হে মুহাম্মদ (সা.)! আপনি আল্লাহর রাসুল’ বলে সম্বোধন করে অদৃশ্য হয়ে যেতেন আবার কখনো আরো কিছু বলতে চাইতেন যা দেখে প্রথম প্রথম তিঁনি বিচলিত হতেন। কখনো বা ভীত হয়ে অন্যত্র চলে যেতেন। হজরত খাদিজা (রা.)-এর নিকট এসব ঘটনার বর্ণনা করলে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, দয়াল রাসুল (সা.) সাধনায় পূর্ণতা পেতে যাচ্ছেন। কারণ, হজরত খাদিজা (রা.)-এর তাওরাত ও ইঞ্জিল কিতাবের ভালো জ্ঞান ছিল। সেখানে সর্বশেষ নবি সম্পর্কে যে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল তার সাথে রাসুল (সা.)-এর মিল পাওয়া যাচ্ছিল। তাই তিনি রাসুল (সা.)-এর মনে সর্বদা সাহসের সঞ্চার করতেন। কোন কোন ব্যক্তি ওই ঐশী মানবকে জিবরাইল (আ.) (আল্লাহর বার্তাবাহক ফেরেশতা) বলে অভিহিত করেছেন। এভাবে রাসুল (সা.) চল্লিশ বছর বয়সে উপনীত হলেন।
নবুয়ত লাভ
অতপর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আসে। ৬১০ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে রমজান, গভীর রাত। রাতের তিন প্রহর অতিবাহিত হয়ে চতুর্থ প্রহর সবেমাত্র শুরু হয়েছে। চারদিক নিরব ও নিস্তব্ধ।
হজরত রাসুল (সা.) গভীর ধ্যানে মগ্ন। সহসা তাঁর কানে এলো, কে যেন তাঁকে ডাকছে- ইয়া মুহাম্মদ!
তিঁনি চোখ মেলে তাকিয়ে অবলোকন করলেন অন্ধকার গুহাটি মুহূর্তেই স্বর্গীয় আলো দ্বারা আলোকিত হয়ে উঠেছে এবং সামনে একজন জ্যোতির্ময় মহাপুরুষ দাঁড়িয়ে আছেন। রাসুল (সা.) তখন বিস্মিত, স্তম্ভিত ও কম্পিত। তাঁর বাহ্যিক জ্ঞান কিছুক্ষণের জন্য লুপ্ত হয়ে যায়। পরক্ষণেই জ্যোতির্ময় মহাপুরুষ তাঁর সাথে আলাপন করলেন।
জ্যোতির্ময় মহাপুরুষ বললেন, আপনি পড়ুন!
রাসুল (সা.) জবাব দিলেন, আমি পড়তে অভ্যস্ত নই।
অতপর ওই মহাপুরুষ রাসুল (সা.)-এর বুকের সাথে আলিঙ্গন করলেন।
পুনরায় বললেন, আপনি পড়ুন!
রাসুল (সা.) আবার জবাব দিলেন, ‘আমি পড়তে অভ্যস্ত নই।
অধিকন্তু ওই মহাপুরুষ রাসুল (সা.)-কে আলিঙ্গন করলেন। এভাবে তৃতীয় বার অতিবাহিত হওয়ার পর রাসুল (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী পড়বো?’ অতপর রাসুল (সা.) জ্যোতির্ময় মহাপুরুষের সাথে পবিত্র কুরআনের পাঁচটি আয়াত (গাঁথা বা শ্লোক) আবৃত্তি করেছিলেন যার বঙ্গানুবাদ হলো,
পড়ুন আপনার মহান প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। যিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্তবিন্দু থেকে। পড়ুন মহামহিম প্রতিপালকের নামে, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। তিঁনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন যা তারা জানত না।’(সুরা: আলাক; আয়াত: ১-৫)
কার্যত, এই ঘটনার মধ্য দিয়ে হজরত রাসুল (সা.) নবুয়তপ্রাপ্ত হন এবং তওহিদ বা একত্ববাদের বাণী প্রচারের গুরু দায়িত্ব লাভ করেন।
পাশ্চাত্য ঐতিহাসিক ক্যারেন আর্মস্ট্রং তার “মুহাম্মদ: অ্যা বায়োগ্রাফি অব দ্য প্রফেট” গ্রন্থে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুয়ত প্রসঙ্গে বলেন, ৬১০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে রমজান মাসে হিজাজের মক্কা নগরীতে একজন আরব ব্যবসায়ী এমন এক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন যা শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাসের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে।
পরিশেষে বলা যায় যে, নবুয়ত লাভ ছিল হজরত মুহাম্মদ (সা.)- এর জীবনে অন্যতম সেরা ঘটনা। এর মাধ্যমে তিঁনি জগতে আল্লাহর প্রেরিত সর্বশেষ নবি ও রাসুল হিসেবে মনোনীত হন এবং ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করে ২৩ বছর নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন।