হিজরত

মানুষ জীবনের বিবর্তনে প্রায়শ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ছুটে যায়। কখনো ইচ্ছায়, কখনো অনিচ্ছায়। কখনো এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায়, কখনো এক শহর থেকে অন্য শহরে আবার কখনো এক দেশ থেকে অন্য দেশে। মূলত এ সবকিছুই হয়ে থাকে প্রয়োজনের তাগিদে। মানুষের এই ছুটে চলার প্রক্রিয়া ক্রমশ বিদ্যমান। এক দেশ হতে অন্য দেশে স্থানান্তরের প্রক্রিয়াকে দেশত্যাগ (আরবিতে-হিজরত) বলে। তেমনি একটি ঘটনার প্রতিফলন লক্ষ করা যায় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, রাহমাতুল্লিল আলামিন, হজরত মুহাম্মদ (সা.)- এর জীবনে। তিঁনি মোহাম্মদী ইসলামের সত্য ও সুমহান বাণী স্বজাতি ও অন্যান্য জাতি এবং গোত্রের নিকট প্রচার করতে গিয়ে অজ্ঞদের রোষানলে পরে নির্মম অত্যাচারের সম্মুখীন হয়েছিলেন। ক্রমে অত্যাচারের মাত্রা চরম আকার ধারণ করলে মহান প্রভুর নিকট হতে প্রত্যাদেশপ্রাপ্ত হয়ে নিজ মাতৃভূমি মক্কা নগরি ত্যাগ করে ইয়াসরিবে (বর্তমান মদিনা) অবস্থান নেন। ইতিহাসে এই ঘটনাকে হিজরত নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর হিজরত

হিজরত আরবি শব্দ। শব্দটি আরবি ‘হিজরুন’ থেকে আগত। এর মূল বর্ণ হা, জিম, রা। যার অর্থ হচ্ছে ত্যাগ করা, প্রস্থান বা গমন করা, পরিত্যাগ করা, সম্পর্ক শেষ করা, দেশত্যাগ করা, এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলে যাওয়া বা স্থানান্তর। তবে, ইতিহাসে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মক্কা থেকে মদিনায় গমন করাকে বুঝায়।

হিজরতের প্রেক্ষাপট

হজরত মুহাম্মদ (সা.) ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে ৪০ বছর বয়সে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নবুয়তপ্রাপ্ত হন। তখন থেকে তিঁনি মহান আল্লাহর নিকট হতে ঐশী বাণী বা প্রত্যাদেশ লাভ করতে থাকেন যাকে আরবিতে ওহি বলা হয়। অতীতে মহান আল্লাহতা’লা কোন কোন নবিকে নির্দিষ্ট জাতি কিংবা বংশের মানুষদের জন্য প্রেরণ করলেও সর্বশেষ নবি ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.) কে সমগ্র সৃষ্টি জগতের জন্য প্রেরণ করেছিলেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, ‘আমি আপনাকে বিশ্ব জগতের প্রতি রহমতসরূপ প্রেরণ করেছি’। (সুরা: আল আম্বিয়া; আয়াত: ১০৭)

অর্থাৎ, হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন সকল মানুষের প্রতি রহমতসরূপ। যার কারণে সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষের নিকট আল্লাহর একত্ববাদের বাণী প্রচার করতে হয়েছিল যা মোটেও সহজ কোন কাজ ছিল না। বলা বাহুল্য যে, মহানবি হজরত মুহাম্মদ (সা.) যে ধর্ম প্রচার করতেন তা ছিল তাঁর পূর্ব-পুরুষদের ধর্ম থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। রাসুল (সা.)-এর প্রচারিত মতবাদে পৌত্তলিকতা বা মূর্তিপূজার কোন স্থান ছিল না। ফলে তাঁর প্রচারিত মতবাদ মেনে নেওয়ার মতো পরিস্থিতি ঐসময় খুব কম মানুষেরই ছিল। তাই তিঁনি ৬১০-৬১৩ খ্রিষ্টাব্দের প্রারম্ভ পর্যন্ত প্রায় তিন (০৩) বছর গোপনে নিকটাত্মীয়দের নিকট ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ রাসুল (সা.) এর রিসালাতের দাওয়াত গ্রহণ করেছিল আবার অনেকেই প্রত্যাখ্যানও করেছিল এবং তাঁর শত্রুতে পরিণত হয়েছিল।

মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত

৬১৩ খ্রিষ্টাব্দে আল্লাহর নিকট থেকে প্রকাশ্যে ইসলামের বাণী প্রচারের প্রত্যাদেশ আসে। আল কুরআনে বর্ণিত হয়- ‘হে চাদর আবৃত ব্যক্তি! উঠ, আর সতর্ক করো এবং তোমার প্রতিপালকের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো। তোমার পরিচ্ছদ পবিত্র রাখ, পৌত্তলিকতা পরিহার করে চল। আর অধিক পাওয়ার প্রত্যাশায় দান করো না এবং তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে ধৈর্য ধারন করো।’ (সুরা: আল মুদ্দাস্সির; আয়াত: ১-৭) । এরপর থেকে তিঁনি প্রকাশ্যে সকলকে সাফা পর্বতের পাদদেশে সমবেত করে ইসলামের বাণী প্রচার করে শান্তি ও সত্যের পথে আহ্বান করেন। এরপর থেকে প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার করতে থাকেন। ইতোমধ্যে হজরত খাদিজা (রা.), হজরত আলি (রা.), হজরত আবু বকর (রা.)সহ প্রমূখ ব্যক্তিবর্গ ইসলামের দাওয়াত গ্রহণ করেছিলেন। তারা রাসুল (সা.)-এর সাথে ইসলাম প্রচারের কাজে অংশগ্রহণ করতেন। ক্রমে মানুষ ইসলামের দাওয়াত গ্রহণ করে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে লাগল। যার ফলে আরবের ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের নিকট মুহাম্মদ (সা.) চক্ষুশূলে পরিণত হয়ে গেলেন। তারা বিভিন্নভাবে মুহাম্মদ (সা.) কে ধর্ম প্রচার থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করে এবং ব্যর্থ হন। তারা রাসুল (সা.) এর অনুসারিদের উপর জুলুম করতে লাগল এমনকি দুই বার আবিসিনিয়ায় হিজরত করতে বাধ্য করল। দয়াল রাসুল (সা.) নিজেও আশ্রয় গ্রহণের জন্য তায়েফে যান কিন্তু তায়েফবাসী রাসুল (সা.) কে গ্রহণ না করে প্রস্তরাঘাত করে তাড়িয়ে দেন। এক সময় মক্কার কাফেরেরা রাসুল (সা.)-এর পরিবারের পাশাপাশি মুসলমানদেরও শোয়াবে আবু তালিবে বয়কট করে।

অবশেষে রাসুল (সা.) কে হত্যার পরিকল্পনা করে আবু জাহেলের নেতৃত্বে একটি ভয়ংকর দল গঠন করা হয়। আবু জাহেলের লোকজন হত্যার জন্য ঔদ্ধত্য হলে আল্লাহর পক্ষ থেকে এই সংবাদ রাসুলকে জানানো হয়-‘স্মরণ করুন, যখন (মক্কার) কাফেররা (দারুন নাদওয়াতে বসে) আপনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল আপনাকে বন্দী করার জন্য অথবা হত্যা করার জন্য অথবা বের করে দেবার জন্য (কিন্তু কিছুই করতে পারেনি)। বস্তুত তারা চক্রান্ত করে আর আল্লাহও কৌশল করেন। আর আল্লাহ হচ্ছের শ্রেষ্ঠ কৌশলী’। (সুরা: আল আনফাল; আয়াত: ৩০)

ইয়াসরিবের মুসলমানদের অনুরোধে এবং আল্লাহর নির্দেশে রাসুল (সা.) ১৪ নববি বর্ষের ২৭শে সফর মোতাবেক ৬২২ খ্রিষ্টাব্দ, হজরত আলি (রা.) কে নিজ বিছানায় শুইয়ে হজরত আবু বকর (রা.) কে সাথে নিয়ে রাতের আঁধারে মক্কা ছেড়ে ইয়াসরিবে হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হন, তখন হাজুনে দাঁড়িয়ে মক্কাবাসী ও বায়তুল্লাহকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, আল্লাহর কসম! নিশ্চয় তুমি আল্লাহর শ্রেষ্ঠ জনপদ ও আল্লাহর নিকট মাটিসমূহের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় মাটি। যদি আমাকে তোমার থেকে বের করে না দিওয়া হত, তাহলে আমি বেরিয়ে যেতাম না। (তিরমিযি হা/ ৩৯২৬, মুস.আহমাদ হা/ ১৮৭৩৯) অতপর হত্যাকারীরা হিজরতের সংবাদ জানতে পেরে রাসুল (সা.) পিছু নিলে তিঁনি সাওর পর্বতের গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করে সেখানে ০৩ দিন অবস্থান করেন। সেখান থেকে কুবায় কিছুদিন অবস্থান করে ইসলামের দাওয়াত প্রচার করেন ও একটি মসজিদ নির্মাণ করে মদিনায় পৌঁছান। সেখানে আওস ও খাযরাজ গোত্র রাসুল (সা.) কে স্বাগত জানায় এবং রাসুলের সম্মানে ইয়াসরিবের নাম পরিবর্তন করে “মদিনা-তুন্-নবি” বা মদিনাতুন্নবি রাখেন যার অর্থ নবির শহর। পরবর্তীতে শুধু মদিনা নামটিই সংরক্ষণ করা হয়।

ক্রমান্বয়ে হজরত আলি (রা.) সহ অন্যান্য সঙ্গীরা মদিনায় হিজরত করেন। যারা রাসুল (সা.)-এর সাথে হিজরত করেছিলেন তারা মুহাজির (হিজরতকারী) এবং যারা আশ্রয় দিয়েছিলেন তারা আন্সার (সাহায্যকারী) উপাধিতে ভূষিত হয়েছিল।

Notableবিশেষ দ্রষ্টব্য: রাসুল (সা.)-এর হিজরতের ঘটনাকে কিছু ঐতিহাসিক ‘পলায়ন’ বা ‘প্রাণভয়ে পলায়ন’ বলে আখ্যা দিয়ে থাকেন। এ সম্পর্কে পাশ্চাত্যের ঐতিহাসিক কার্ল ব্রোকেলম্যান বলেন, ‘মহানবি (সা.)-এর এ হিজরত পলায়ন ছিল না, তা ছিল স্থানান্তর, যা তাঁর জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করেছিল’।

প্রকৃতপক্ষে হজরত রাসুল (সা.)-এর এই হিজরত ছিল জীবনের বিবর্তনের জন্য।

মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের কারণ

মক্কাবাসীর অমানুষিক নির্যাতন

হজরত মুহাম্মদ (সা.) যখন মক্কাবাসীর নিকট মহান আল্লাহর সত্য ও সুমহান বাণী প্রচার করতেন তখন এই বাণীগুলো মক্কাবাসীদের নিকট নতুন মনে হতো। যা কখনো তাদের পূর্ব-পুরুষদের ধর্মের বিপরীত মনে হতো। অনেকই রাসুল (সা.)-এর প্রচারিত মতবাদ প্রত্যাখ্যান করলো এবং এই মতবাদ প্রচার করতে নিষেধ করলো। কিন্তু রাসুল (সা.) সত্য প্রচারে বিরত থাকেননি। যে কারণে মক্কার বেশ কিছু কাফের রাসুল (সা.)-কে বিভিন্নভাবে অত্যাচার করতে শুরু করে।

পরিবেশগত কারণ

ভৌগলিকভাবে মক্কা ছিল অধিক মরুভূমির দেশ। সেখানকার তাপমাত্রা পার্শবর্তী অঞ্চলগুলোর তুলনায় বেশি এবং গাছপালা তুলনামূলক কম। তাই মক্কার মানুষের মেজাজ ছিল কিছুটা রুক্ষ। তারা সহজে রাসুল (সা.)-কে গ্রহণ না করে বিরোধিতা করা শুরু করে। অপরদিকে মদিনার আবহাওয়া ছিল মক্কার আরামদায়ক। মদিনার মানুষেরা ছিল শান্তিপ্রিয়। তাই মদিনাবাসীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে রাসুল (সা.) সেখানে হিজরত করেন।

আকাবার শপথ

আকাবায় ৬২১ খ্রিষ্টাব্দে ইয়াসরিবের আওস ও খাযরাজ গোত্রের ১২ জন ইসলামের দাওয়াত গ্রহণ করে শান্তিতে থাকার শপথ নেন। দ্বিতীয়বার ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে ইয়াসরিবের আওস ও খাযরাজ গোত্রের ৭৫ জন লোক ইসলামের দাওয়াত গ্রহণ করে তারাও শান্তিতে থাকার শপথ নেন। পরবর্তীতে এই লোকদের নিমন্ত্রণে মদিনায় হিজরত করেন।

আত্মীয়তার সম্পর্ক

মহানবি (সা.)-এর পিতা এবং পূর্বপুরুষ হাশিমের মদিনায় বিবাহ করেছিলেন। যে কারণে ছোটবেলা থেকেই রাসুল (সা.) সেখানে যাতায়াত করতেন। সেখানকার লোকজন ও পরিবেশের সাথে আগেই পরিচিত ছিলেন তাই তিঁনি মদিনায় হিজরত করেছিলেন।

মধ্যস্ততার কারণ

৬২২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ইয়াসরিব তথা মদিনার আওস ও খাযরাজ গোত্রের মধ্যে দ্বন্দ চলছিল। ক্রমে যুদ্ধের রূপ পরিগ্রহ করলে আকাবায় শান্তিতে বসবাস করার শপথ নেওয়া মুসলমানগণ রাসুল (সা.)- কে আহ্বান করেন মদিনায় আগমন করে সংগঠিত হতে যাওয়া ‘বুয়াস’ যুদ্ধের অবসান ঘটাতে। শৈশব থেকেই মদিনায় রাসুল (সা.)-এর গ্রহণযোগ্যতা ছিল। তিঁনি সেখানে গিয়ে বুয়াস যুদ্ধের মধ্যস্থতা করেন।

মদিনার ধর্মীয় অবস্থা

মদিনায় বিদ্যমান পৌত্তলিকতা ও জড়বাদ মদিনাবাসীরা অপছন্দ করতো এবং সর্বদা শান্তির ধর্মের জন্য অপেক্ষা করতো। মুহাম্মদ (সা.)-এর ধর্ম শান্তির হওয়ায় তারা সকলে সম্মত হয়ে রাসুল (সা.)-কে মদিনায় অহ্বান করেন।

মুসাবের অনুকূল মতামত

হিজরতের পূর্বে রাসুল (সা.) ‘মুসাব’ নামক একজন সাহাবিকে মদিনায় প্রেরণ করেন সেখানকার সার্বিক পরিস্থিতি অবলোকন করার জন্য। মুসাবের দ্বারা সার্বিক দিক পর্যবেক্ষন করে হিজরতের অনুকূল পরিস্থিতি নিশ্চিত হওয়ার পর তিঁনি মদিনায় হিজরত করেন।

নবি-কে হত্যার পরিকল্পনা

কুরাইশরা বিভিন্নভাবে রাসুল (সা.)- কে ইসলামের বাণী প্রচার থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। অবশেষে তারা রাসুল (সা.) কে হত্যার পরিকল্পনা করে।

আল্লাহর প্রত্যাদেশ লাভ

রাসুল (সা.) কুরাইশদের হত্যার পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে পরার পর আল্লাহর নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। অতপর মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে হিজরতের নির্দেশপ্রাপ্ত হয়ে মদিনায় হিজরত করেন।

হজরত মুহাম্মদ (সা.) স্বেচ্ছায় মক্কা ছেড়ে মদিনায় স্থানান্তরিত হননি। যখন তিঁনি মোহাম্মদী ইসলামের দাওয়াত প্রচার করতে গিয়ে চরম প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হন তখন আল্লাহর নির্দেশপ্রাপ্ত হয়ে ইয়াসরিবে (মদিনা) নগরিতে হিজরত করেছিলেন যা ইতিহাসের অন্যতম স্মরণয় ঘটনা। মূলত ইসলামের ইতিহাসে হিজরত নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক জোসেফ বলেন, হিজরত ইসলামের ইতিহাসে মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা। পরিশেষে বলা যায় যে, হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর হিজরত বা স্থানান্তরিত হয়েছিলেন ব্যক্তি স্বার্থে নয়, সবকিছুই হয়েছিল সত্য ও ন্যায়ের বাণী প্রতিষ্ঠার জন্য।

মন্তব্য করুন

en_USEnglish