হযরত মুহাম্মদ (স.) এর জীবনে যুদ্ধ সমূহের প্রেক্ষাপট ও সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা

"ওয়ামা আরসালনাকা ইল্লা রাহমাতাল্লিল আলামিন"
অর্থ:- হে রাসূল (স) আমিতো আপনাকে জগতসমূহের প্রতি কেবল রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি।" (সূরা আল আম্বিয়া-২১, আয়াত– ১০৭)

সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহম্মদ (স.)। যাঁকে মহান রাব্বুল আলামীন সারা জাহানের জন্য রহমত, বরকত ও শান্তির দূত হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। তিনি কি কখনো দ্বন্দ, সংঘাত, সংগ্রামে লিপ্ত হতে পারেন?

মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত। সৃষ্টির সেরা জীব। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে অসীম ভালবাসেন। এই ভালাবাসার প্রিয় মানুষেরা যাতে পথ ভূলে না যায়, সে জন্য তিনি তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য সর্বকালের সর্বযুগে মহামানব তথা আল্লাহর প্রতিনিধি প্রেরণ করেছেন। যাকে নূরে মোহাম্মদী বলা হয়। এই নূরে মোহাম্মদীর নূর সৃষ্টির শুরুতে সর্বপ্রথম মহান আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি করেছেন। এই প্রসঙ্গে হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেন — " আউয়ালু মা খালাক্বাল্লাহু নূরী"

অর্থ:- "মহিমান্বিত আল্লাহ সর্বপ্রথম আমার নূর সৃষ্টি করেছেন।" (তাফসীনর রুহুল বয়ান ২য় খণ্ড পৃষ্ঠা ৩৭০)

হযরত মুহাম্মদ (স.) এর সৃষ্টি পৃথিবীর শুরুতে, কিন্তু আগমন করলেন সকল নবী রাসূলগনণের শেষে। মর্যাদার আসনে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ। তিনি সকল নবী রাসূলগনের সরদার ছিলেন। এজন্য তাকে বলা হয়েছে “ইমামুল মুরসালিন’’ অর্থ প্রেরিত সকল নবী রাসুলগণের ইমাম, সরদার বা নেতা। হযরত মুহাম্মদ (স.) ছিলেন একজন কোমল,নমনীয়,মধুর,সুবিবেচক,শান্ত , ক্ষমাশীল, শান্তিদায়ক ও নরম দিলের মহামানব। এই মহামানবের নামের সাথে যুদ্ধ,বিগ্রহ কথাটি একেবারেই বেমানান। যাহা আমাদের জন্য দুঃখজনক,হতাশাজনক ও হৃদয়বিদারক। মহান রাব্বুল আলামিন যাকে জগতের জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছেন, তিনি কি আসলেই যুদ্ধবাজ ছিলেন? আমার আলোচনায় এই বিষয়টি একটু পরিষ্কার করার চেষ্টা করব ইহুদী-খ্রিষ্টানরা প্রচার করে হযরত মুহাম্মদ (স.) একজন যুদ্ধবাজ, তিনি যুদ্ধ করে জীবন কাটিয়েছেন।

আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত যে,রাসুল (স.) ৬৩ বছর হায়াতে জিন্দেগীতে ২৭টি যুদ্ধ করেছেন। বর্বর আরব জাতি,ইহুদী,নাসারা,বিধর্মী লোকেরা যখন রাসূলকে আক্রমণ করতে এসেছে তখন তিনি তা প্রতিহত করেছেন । কোন যুদ্ধই তিনি আক্রমনাত্মক যুদ্ধ করেন নাই। সকল যুদ্ধি ছিল আত্মরক্ষামূলক ও প্রতিরোধমূলক। কোনও যুদ্ধ প্রত্যক্ষভাবে আবার কোন যুদ্ধে তিনি পরোক্ষভাবে তিঁনি অংশগ্রহণ করেছেন। তবে সকল যুদ্ধের তিনি ছিলেন সর্বাধিনায়ক,পরিকল্পনাকারী ও রূপদানকারী।

যুদ্ধ:

যুদ্ধ শব্দের অর্থ সংগ্রাম, লড়াই, সমর, বিগ্রহ, রন। ইংরেজীতে বলা হয় – War, Fight, Battle আরবীতে বলা হয় গাযওয়া বা জিহাদ।

যুদ্ধ কাকে বলে?

যুদ্ধ, সংগ্রাম বা লড়াই বলতে কোন নির্দিষ্ট ভূখন্ডে, রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় পক্ষগুলোর মধ্যে সংঘটিত এবং কখনো কখনো দীর্ঘস্থায়ী সশস্ত্র সংঘর্ষকে যুদ্ধ বলা হয়। অন্যভাবে বলা যায় যুদ্ধ হল রাজ্য, সরকার, সমাজ বা আধাসামরিক বাহিনী এবং যে কোন প্রকারের সামরিক বাহিনীর মধ্যে নিজস্ব মতাদর্শ বা অধিকার আদায়ের জন্য তীব্র সশস্ত্র সংঘর্ষ।

Kinds of war

  • জৈবিক যুদ্ধ
  • রাসায়নিক যুদ্ধ
  • ঠান্ডা যুদ্ধ বা স্নায়ুযুদ্ধ
  • প্রচলিত যুদ্ধ
  • সাইবার যুদ্ধ
  • তথ্য যুদ্ধ
  • পারমাণবিক যুদ্ধ
  • সর্বাত্মক যুদ্ধ

হযরত মুহাম্মাদ (স.) যখন মক্কার মানুষের কাছে বললেন- “আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়, তিনি চিরন্জীব, লা শরীক। তিনি আমাদের সৃষ্টিকর্তা, লালনকর্তা, পালনকর্তা। তখনই আরবের মানুষের মাঝে আকাশের বাজ ভেঙে পড়লো। এতো দিন তারা নানা দেব-দেবীর পূজা করতো, দেব-দেবীকে তারা সৃষ্টিকর্তা ভাবতো। আর মুহাম্মাদ বলছে এগুলো ছেড়ে এক আল্লাহর ইবাদত করার জন্য। এরপর থেকে হযরত মুহাম্মাদ (স.) কে আর তারা আল আমীন ভাবতে পারছে না। হযরত মুহাম্মাদ (স.) পৌত্তিলিকতা, পুরাতন কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাস ত্যাগ করে পবিত্র ধর্ম সত্য, শান্তি, স্নেহ, প্রেম, ভালোবাসার ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার জন্য আকুল আবেদন জানান। কুরাইশ নেতাসহ সবাই এর ঘোর বিরোধিতা করে এবং ধর্ম প্রচারে বাধা প্রদান করে। কুরাইশদের বাধা প্রদানের কারণে হযরত মুহাম্মাদ (স.) মক্কায় আগত সাধারণ মানুষ ও বণিকদের মাঝে ধর্ম প্রচারে আত্ম নিয়োগ করেন। আগমণকারী ব্যক্তিরা শান্তির ধর্ম গ্রহণ করে দেশে ফিরে তা প্রচার করতো। এইভাবে দিন দিন মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলো এবং ইসলামে প্রচার ও প্রসার হলো। দিন দিন মুসলমান সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে কুরাইশগণ ভীত ও সংকীত হইয়া হযরত মুহাম্মাদ (স.) এর উপর শারীরিক, মানসিক সকল প্রকার নির্যাতন শরু করলো। কুরাইশ নেতারা হযরত মুহাম্মাদ (স.) কে টাকা, পয়সা, ধন-দৌলত, সুন্দরী রমণী, রাজত্বসহ বহু লোভনীয় প্রস্তাব দিল। হযরত মুহাম্মাদ (স.) বললেন- “আমার এক হাতে চাঁদ অন্য হাতে সাম্রাজ্য দিলেও আমি আমার সত্য ধর্ম প্রচারে একবিন্দুও পিছু হটবো না।“ হযরত মুহাম্মাদ (স.) সকল প্রস্তাব প্রত্যাখান করে কুরাইশদের অত্যাচার ও অবিচারের কারণে মদিনা হিজরত করলেন। মদিনা গিয়েও শান্তিপূর্ণ ভাবে ধর্ম প্রচার করতে পারেন নাই। সেখানেো কুরাইশরা নানা বাধা-বিপত্তি দিল। যখন তাদের আক্রমণ চরম আকারে পৌছালে তখনই হযরত মুহাম্মাদ (স.) তা প্রতিহত করার সিদ্ধান্ত নেন।

রাসুল (স.) এর মদীনার সম্পূর্ণ জীবন কাটে জিহাদের মধ্যে। জিহাদ দুই ধরনের।

গাযওয়া: যে সকল যুদ্ধে হযরত মুহাম্মাদ (স.) সরাসরি অংশগ্রহণ করতেন এবং নেতৃত্ব দিতেন তাকে গাযওয়া বলা হয়।

সারিয়া: যে সকল যুদ্ধে হযরত মুহাম্মাদ (স.) সরাসরি অংশগ্রহণ করেন নাই তাকে সারিয়া বলা হয়।

হযরত মুহাম্মাদ এর জীবনে উল্লখযোগ্য কিছু যুদ্ধ বা গাযওয়ার নাম উল্লেখ করা হলো:

  • হরবুল ফুজ্জার (৫৯০ খ্রিষ্টাব্দ)
  • বদরের যুদ্ধ (৬২৪ খ্রিষ্টাব্দ-১৫ই মার্চ)
  • ছাতুর যুদ্ধ (৬২৪ খ্রিষ্টাব্দ-মে/জুন)
  • উহুদের যুদ্ধ (৬২৫ খ্রিষ্টাব্দ-২৩ শে মার্চ)
  • খন্দকের যুদ্ধ (৬২৭ খ্রিষ্টাব্দ-এপ্রিল)
  • হুদাইবিয়ার সন্ধি (৬২৮ খ্রিষ্টাব্দ-মার্চ)
  • খায়বারের যুদ্ধ (৬২৮ খ্রিষ্টাব্দ-মে/জুন)
  • মুতা’র যুদ্ধ (৬২৯ খ্রিষ্টাব্দ-সেপ্টেম্বর)
  • হুনাইনের যুদ্ধ (৬৩০ খ্রিষ্টাব্দ-জানুয়ারি)
  • অটাসের যুদ্ধ (৬৩০ খ্রিষ্টাব্দ)
  • তাবুকের যুদ্ধ (৬৩০ খ্রিষ্টাব্দ-অক্টোবর/ডিসেম্বর)

হরবুল ফুজ্জার যুদ্ধ

হযরত মুহাম্মাদ এর বয়স যখন ২০ বছর ৫৯০ খ্রিস্টাব্দ,তখন কুরাইশ ও কায়েস গোত্রের মধ্যে অনাহত কারণে একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ওকায মেলায় তারা সকলেই আনন্দ উৎসব করতে এসেছিল। এ সময় আরব গোত্রের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ ছিল। পবিত্র মাসে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয় বলে ইহাকে ‘হরবুল ফুজ্জার’ বা অপবিত্র যুদ্ধ বলা হয়।হযরত মুহাম্মাদ (স.) তাঁর চাচা আবু তালিবের সহিত যুদ্ধে যোগদান করেন, শত্রুপক্ষের তীর সংগ্রহ করিয়া চাচার হাতে তুলে দেওয়া ছিল হযরত মুহাম্মাদ (স.) এর কাজ।এই যুদ্ধ পাঁচ বছর স্থায়ী ছিল।

মানবতার এই চরম বিপর্যয় দেখে হযরত মুহাম্মাদ (স.) এর কোমল হৃদয়ে রেখাপাত করে।ইহার প্রতিকারের জন্য ৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে কতিপয় উৎসাহী যুবকদের সমন্বয়ে একটি শান্তি সংঘ গঠন করেন। ফজল, ফাজেল, ফাজায়েল ও মুফাজ্জেল এই চারজন বিশিষ্ট সভ্যের নামানুসারে এই সংঘের নাম করন করা হয় হিলফুল ফুজুল বা শান্তি সংঘ। অন্যায়, অত্যাচার, ব্যাভিচার, জুলুম নির্যাতন অবসান করিবার জন্য সভ্যগণ নিম্নের শপথ গ্রহণ করেনঃ

  • দেশে শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত করবেন
  • অত্যাচারকে সাধ্য অনুযায়ী বাধা দিবেন
  • দুর্বল, এতিম, নিঃস্ব, অসহায় কে সাহায্য করবেন
  • বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে সম্প্রীতি ও সমভাব স্থাপনের চেষ্টা করবেন
  • বিদেশি লোকদের মান, সম্মান ও ধন-দৌলত রক্ষা করিবার জন্য যথাসম্ভব চেষ্টা করিবেন

হযরত মুহাম্মাদ (স.) সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় হিলফুল ফুজুল অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন।সর্বপ্রথম তিনি এইভাবে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসেন

বদরের যুদ্ধ:

মদিনায় ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠা ও হযরত মুহাম্মাদ (স.) এর প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধির কারণে মক্কার কুরাইশরা শঙ্কিত ও ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠে। ইসলামী প্রজাতন্ত্র গঠন ও মুসলমানদের আধিপত্য বিস্তারে বিধর্মীরা ইসলাম ধর্ম ও মদিনাবাসীদের নিশ্চিহ্ন করার দৃঢ় সংকল্প করিলে মুসলমানদের সঙ্গে বিধর্মীদের ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে বদর প্রান্তে যে যুদ্ধ সংঘটিত হয় তাকে বদরের যুদ্ধ বলা হয়।ইসলামের ইতিহাসে ধর্ম নিয়ে বিধর্মীদের সাথে এটাই প্রথম যুদ্ধ। 

বদরের যুদ্ধে মুসলিম সৈনিক সংখ্যা ছিল ৩১৩ জন। এর মধ্যে মুহাজির ছিলেন ৮২ জন, আনসার ছিলেন ২৩১ জন। 

মুসলমানদের ৭০টি উট ও ২টি ঘোড়া ছিল। কুরাইশদের সৈনিক ছিল ১৩০০ জন। অসংখ্য উট,১০০ টি ঘোড়া, ও ৬০০ লৌহবর্ম ছিল। আবু জাহিল কুরাইশদের নেতৃত্ব দেন। 

মদিনা হতে ৮০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে বদরের উপত্যকায় যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে কুরাইশদের ৭০ জন নিহত হয় ও ৭০ জন বন্দী হয়। মুসলমানদের ১৪ জন সৈনিক শহীদ হন। যুদ্ধে আবু জাহিলসহ কুরাইশদের প্রধান তিনজন সৈন্য নিহত হওয়ার পর তাদের মনোবল ভেঙে যায়।মুসলমানরা বদরের যুদ্ধে জয়লাভ করে। 

যুদ্ধ বন্দীদের প্রতি উদার ও মধুর ব্যবহারে হযরত মুহাম্মাদ (স.) মহানুভবতার পরিচয় দেন।বন্দীরা চার হাজার দিরহামে মুক্ত হতে পারবে। যদি তা দিতে না পারে তাহলে মুসলমান বালকদের শিক্ষাদান করিবার অঙ্গীকারের মাধ্যমে মুক্ত হওয়া যাবে। এর ফলে মুসলমানদের মধ্যে দ্রুত শিক্ষা বিস্তার লাভ করে। এই যুদ্ধে জয়লাভের জন্য মুসলমানরা শৃঙ্খলা, সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শন করেছিলেন। ইহা মুসলমানদের পরবর্তী বিজয়ের উৎসাহ ও প্রেরণা যুগিয়েছিল।বিশ্বজয়ের প্রথম সূত্রপাত বদরের যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে সূচনা হয়।

উহুদের যুদ্ধ:

বদরের যুদ্ধে কুরাইশদের শোচনীয় পরাজয়ের পর তার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মক্কার উপত্যকায় যুদ্ধের হুংকার দেন কুরাইশ নেতা আবু সূফিয়ান শপথ নিলো যে বদরের যুদ্ধের প্রতিশোধ না নিয়ে তারা তৈল বা নারী স্পর্শ করবেনা।

কুরাইশদের ৩০০০ জন সৈন্য ৩০০টি উট ও ২০০টি ঘোড়া নিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়। পক্ষান্তরে হযরত মুহাম্মাদ (স.) মাত্র ১০০০ জন সৈনিক ৫০ টি তীরন্দাজ ও ৪টি ঘোড়া নিয়ে দৃঢ় মনোবল সহকারে উহুদের দিকে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে আব্দুল্লাহ বিন উবাই তার ৩০০ জন অনুচর নিয়ে পথিমধ্যে পলায়ন করলে সৈন্য সংখ্যা দাঁড়ায় ৭০০ জন। এ হতে শিক্ষা পাওয়া যায় যে মুনাফেক আপন লোক হয়। নিজ গৃহে অবস্থান করে আপন মানুষের ক্ষতি করে সুযোগ বুঝে কেটে পড়ে। উহুদের যুদ্ধ পরজয়ের এটিও একটি কারন। সূফী স্কলার্স প্রফেসর ড. কুদরত এ খোদা (মাঃআঃ) বলেন-“মুনাফেক থেকে কাফের ভালো, কারণ কাফের চেনা যায় কিন্তু মুনাফেক চেনা যায় না।“

যুদ্ধে রাসূলের নির্দেশ ছিল যে ,জয়-পরাজয় যা হউক পরবর্তী নির্দেশ ছাড়া কেউ নিজের স্থান ত্যাগ করবে না। রাসূলের এই আদেশ অমান্য করে মুসলমানদের বিজয় সুনিশ্চিত ভেবে মুসলমান সৈন্যগণ গণিমতের মালামাল লুন্ঠন করার জন্য সুরক্ষিত গিরিপথের রক্ষনাবেক্ষন ছেড়ে স্থানত্যাগ করে। আইনাইন পাহাড়ের অরক্ষিত পথ দর্শনে বিধর্মীদের দলপতি খালেদ পশ্চাত ও পাশদেশ হতে মুসলমান বাহিনীকে আক্রমণ করে।

উহুদের যুদ্ধ মুসলিম জাতির জন্য একটি চরম শিক্ষা, কারণ হযরত মুহাম্মাদ (স.) এর আদেশ অমান্য করার কারণে বাহিনী বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। এবং হযরতের দু’টি দাঁত শহীদ হয়। তিনি মাটিতে লুটাইয়া পড়েন এবং জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন, তার ফলে বিধর্মী শিবিরে গুজব ছড়িয়ে পড়ে রাসূল (স.) মারা গেছে। এই যুদ্ধে হযরত মুহাম্মাদ (স.) এর চাচা হযরত আমীর হামজা (রা.) সহ ৭০ জন মুসলিমযোদ্ধা শহীদ হন।বিধর্মীদের মাত্র ৩০/৩৭ জন নিহত হন। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা হযরত হামজা (রা,) এর কলিজা চর্বন করিয়া পিতা হত্যার প্রতিশোধ নেন। হযরত আবু বকর (রা.), হযরত ওমর (রা.), হযরত আলী (রা.) সহ প্রায় ১১ জন সাহাবী আহত হন।

এই যুদ্ধের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো,রাসূল (স.) এর নির্দেশ অমান্য করলে কী হতে পারে, হযরত মুহাম্মাদ (স.) একজন ভবিষয়ৎ স্বপ্নদ্রষ্টা তার প্রমাণ মিলে। অপরদিকে হযরত মুহাম্মাদ (স.) এর আশেকে প্রেমিক ওয়াজ করনী, হযরত মুহাম্মাদ (স.) দাঁত মোবারক শহীদ হওয়ার ঘটনা জানতে পেরে নিজের সকল দাঁত ভেঙে নবী প্রেমের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা আশেক ও মাসুকের প্রেমের এক বিরল উদাহরণ। উহুদের যুদ্ধ প্রকৃতপক্ষে মুসলমানদের জন্য ঈমান ও ধৈর্য্যের পরীক্ষা ছিল। মুসলমানদের ভক্তি বিশ্বাস ও আত্ম-জিঙ্গাসার এক কঠিন পরীক্ষা। এই যুদ্ধে পরাজয়ের পর মুসলমানরা সুশৃঙ্খলব্দ আত্মবিশ্বাসী সামরিক জাতিতে পরিণত হয়।

খন্দকের যুদ্ধ:

উহুদের যুদ্ধে জয়লাভের পর কুরাইশরা আরো ভালোভাবে, প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে মুসলমানদের আক্রমণ করার প্রস্তুতি নেন। তাদের ধারণা মুসলমানদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে তাদের সামাজিক ধর্মীয় ও অথনৈতিক সুযোগ সুবিধা বিনিষ্ট হতে পারে।তাই কুরাইশদের শক্ত অবস্থান জানান দেওয়ার জন্য শেষ বারের মতো লড়িবার জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করলো।কুরাইশ,ইহুদী ও আরবের অন্যান্য গোত্র মিলে জোটগতভাবে যুদ্ধ করার পণ করেন।

পক্ষান্তরে উহুদের যুদ্ধের পরাজয়ের গ্লানি মুছার জন্য সর্বাত্মক শক্তি, সাহস, ভক্তি ও বিশ্বাস নিয়ে তারা একত্রিত হলো মুসলিম সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি করলো, এ যুদ্ধে মুসলমানরা এক অভিনব কৌশল অবলম্বন করলো। পারস্যের হযরত সালমান ফারসীর পরামর্শক্রমে এই কৌশল অবলম্বন করা হয়। অভিনব কৌশলটি মদিনার চতুরদিকে যে সকল স্থান অরক্ষিত আছে ঐ সকল স্থানে গভীর পরিখা খনন করা হলো। হযরত মুহাম্মাদ (স.) পরীখা খননের কাজে নিজে তদারকি করলেন। আত্মরক্ষামূলক এই ব্যবস্থায় শিশু ও নারীদের নিরাপদ দূর্গ ও তাবুতে আশ্রয় প্রদান করা হয়। আরবের ইতিহাসে পরীখা খনন দ্বারা শত্রুর মোকাবেলা করার এই অভিনব কৌশলটি সর্বপ্রথম হযরত মুহাম্মাদ (স.) গ্রহণ করেন। পরীখার আরবি শব্দ খন্দক।তাই এই যুদ্ধের নামকরণ করা হয় খন্দকের যুদ্ধ। এই যুদ্ধ ২৭ দিন স্থায়ী ছিল। জোট বাহিনীর সংখ্যা ছিলো ১০,০০০ জন, ৬০০ টি ঘোড়া ও কিছু উট। পক্ষান্তরে মুসলমান বাহিনীর সংখ্যা ছিলো ৩০০০ জন, এখানে উল্লেখ্য যে মদিনার লোকসংখ্যা থেকে জোটবাহিনীর সংখ্যা বেশী। এই যুদ্ধে কুরাইশদের ১০ জন সৈন্য মারা যায় এবং মুসলমানদের ৬/৮ জন সৈন্য শহীদ হন।মুসলমানদের অপ্রতিরোধ্য আক্রমণ ও বৈরী আবহাওয়ার কারনে শত্রুপক্ষ পিছু হটতে থাকে।মুসলমানদের সুসংগঠিত অবস্থা, প্রবল আত্মবিশ্বাস খন্দকের যুদ্ধে জয় এনে দেয়। ইসলাম পূর্বের চেয়ে আরো বেশী গতিশীল হয়।

হুদাইবিয়ার সন্ধি:

মক্কার কুরাইশদের অত্যাচারে মহান রাব্বুল আলামীনের নির্দেশে হযরত মুহাম্মাদ (স.) মদিনায় হিজরত করেন।তারপর দীর্ঘ ছয় বছর যাবত হজ্ব করিতে পারেন নাই এবং জন্মভূমিতে যাইতে পারেন নাই। তিনি জন্মভূমিকে দেখার এবং হজ্ব করার সংকল্প গ্রহণ করলেন। ৬২৮ খ্রিস্টাব্দ জ্বিলকদ মাসে ১৪০০ সাহাবী নিয়ে মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন।জ্বিলক্বদ মাস পবিত্র মাস হওয়ায় এই মাসে যুদ্ধ বিগ্রহ নিষিদ্ধ ছিল। এই প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে “ইয়াসআলূনাকা আনিশ শাহরিল হারামি কিতালিম ফীহি কুল কিতালুনফীহি কাবীর।“

অর্থ: ”হে আল্লাহর রাসুল (স.) তারা পবিত্র মাসে যুদ্ধ করা সম্পর্কে জানতে চায়। আপনি তাদের বলে দিন পবিত্র মাসে যুদ্ধ করা মহাপাপ।“ (সূরা বাকারা-২, আয়াত-২১৭)

কিন্তু কথায় আছে “চোরে নাহি শোনে ধর্মের কাহিনী”।মক্কায় হযরত মুহাম্মাদ (স.) এর আগমনের সংবাদ শুনে কুরাইশগণ তা প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। হযরত মুহাম্মাদ (স.)মক্কার উপকন্ঠে নয়মাইল দূরে হুদাইবিয়া নামক স্থানে তাবু স্থাপন করেন। হযরত মুহাম্মাদ (স.)পক্ষে যারা বিন উমাইয়া এবং ওসমান বিন আফনানকে বিশেষ দূত নিযুক্ত করে কুরাইশদের নিকট সংবাদ পাঠাইলেন যে, হযরত মুহাম্মাদ (স.) শুধুমাত্র হজ্ব করার উদ্দেশ্যে এসেছেন,যুদ্ধ করার জন্য নয়।কুরাইশরা এই শান্তি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে ওসমানকে আটকিয়ে রাখলো।এই সংবাদ মুসলমান তাবুতে পৌছালে তারা তা প্রতিশোধের জন্য সবাই আমরন সংগ্রামের শপথ নিলেন।মুসলমানদের কঠিন প্রতিবাদের কথা কুরাইশদের মাঝে পৌছালে তারা ভয়ে আতংকে মুসলমানদের সাথে আলাপ আলোচনায় বসলেন।উভয় পক্ষের মাঝে একটি সন্ধি হলো যা হুদাইবিয়ার সন্ধি নামে পরিচিত।হুদাইবিয়ার সন্ধির উল্লেখযোগ্য কিছু শর্ত নিচে উল্লেখ করা হলো:

  • মুসলমানগণ এই বছর হজ্ব না করিয়া মদিনায় ফিরে যাবেন।
  • আগামী বছর মুসলমানগণ হজ্ব করিতে পারবেন, কিন্তু তিন দিনের বেশি মক্কায় থাকতে পারবেন না। এই তিন দিন কুরাইশগণ নগর ছাড়িয়া অন্যত্র আশ্রয় লইবে।
  • কেউই অস্ত্র নিয়ে আসতে পারবে না, তবে আত্মরক্ষার জন্য শুধু তরবারি খাপে ভরিয়া রাখিতে পারিবে।
  • হজ্বের সময় মুসলমানদের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান করিতে হইবে।
  • মক্কায় অবস্থানকারী কোন মুসলমানকে হযরত মুহাম্মাদ (স.) মদিনায় নিয়ে যেতে পারবেন না।
  • যদি কোন মুসলমান কুরাইশদের দলে যোগ দেয় তাহলে তাকে আর ফেরত দেওয়া হবে না, কিন্তু কোন কুরাইশ মুসলমানে দলে যোগ দিলে, তার অভিভাবক চাইলে তাকে ফেরত দিতে হবে।
  • কুরাইশ ও মুসলমানদের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ দশ বছরের জন্য স্থগিত থাকিবে।

হুদাইবিয়ার সন্ধির শর্ত অনুযায়ী হযরত মুহাম্মাদ (স.)এর কোমল হৃদয়ে নমনীয়তার যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন এই শিক্ষা অনুসরণ করে ভারতের সাবেক রাস্ট্রপতি এপিজি আবুল কালাম বলেছেন “সব কথার জবাব দিতে নেই, সম্মান বাঁচাতে কখনো কখনো নীরব থাকতে হয়।“ সব যুদ্ধে এগিয়ে যেতে নেই, জয়ের জন্য কখনও কখনও পিছিয়ে যেতে হয়। সব সময় সব সম্পর্ক আকড়ে ধরতে নেই। সম্পর্ক বাচাতে কখনও কখনও দূরে থাকতে হয়।

হুদাইবিয়ার সন্ধির লেখক ছিলেন হযরত আলী (রা.) কুরাইশ প্রতিনিধি সুহাইল বিন আমর সন্ধিপত্র থেকে “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম এবং মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ “বাক্য দুটি কেটে দিলেন। সুহায়েল বিন আমরের দাবি অনুযায়ী”বিছমিকা আল্লাহুম্মা “বাক্যটি লেখার নির্দেশ দেন। মুহাম্মাদ (স.) যে শান্তির চরিত্রের অধিকারী তার বহিঃপ্রকাশ ঘটলো। হুদাইবিয়ার সন্ধির ফলে মক্কায় ইসলাম প্রচার আরো বেগবান ও সহজ হয়। সন্ধির কোন শর্ত ইসলাম পরিপন্থী ছিল না বরং পরোক্ষভাবে প্ররণাদায়ক ছিল। মুসলমানদের সাথে বেদুঈন গোত্রের অবাধ মেলামেশার সুযোগ থাকার ফলে ইসলামের পরিসর বৃদ্ধি পায়। এর ফলাফল আমরা দেখতে পাই হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় হযরত মুহাম্মাদ (স.) এর সঙ্গী ছিল ১৪০০ মুসলমান, তার দুই বছর পর ৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের সময় মুসলমানদের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০,০০০,এর পরের দুই বছর পর ১০ম হিজরীতে মুহাম্মাদ (স.) প্রায় ১,২৪,০০০ জন মুসলমানদের উপস্থিতিতে বিদায় হজ্বের ভাষণ দেন।

হযরত মুহাম্মাদ (স.) ছিলেন বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার অগ্রদূত। শান্তি প্রতিষ্ঠায় হযরত মুহাম্মাদ (স.) এর অবদান সর্বজন স্বীকৃত। ধর্মের মৌলিক শিক্ষা আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে বর্বর আরব জাতি একটি উত্তম জাতিতে পরিণত হয়েছে।

হযরত মুহাম্মাদ (স.) ৪০ বছর বয়সে নবুয়ত লাভ করেন। সাড়ে বায়ান্ন বছর বয়সে মেরাজের রজনীতে নামাজের বিধি-বিধান আসে। তাহলে এই সাড়ে বারো বছর তিঁনি বর্বর আরব জাতিকে কোন শিক্ষায় শিক্ষিত করে নিজের দিকে দীক্ষিত করেছেন। তিনি তাদের সর্বপ্রথম আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে মোরাকাবা করে নিজের চরিত্র সংশোধনের মাধ্যমে উত্তম চরিত্রের মানুষে পরিণত করেছেন।

“ক্বাদ আফলাহা মান ঝাক্কাহা, ওয়া ক্কাদ খাবা মান দাসসাহা”

অর্থঃ- অবশ্যই সফলকাম হয়েছে সে,যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করেছে। আর অবশ্যই সে ব্যর্থ হয়েছে, যে নিজেকে পাপাচারে কলুষিত করেছে। (সূরা আস শামস -৯১, আয়াত ৯-১০)

হযরত মুহাম্মাদ (স.) ইসলামের মৌলিক শিক্ষার মাধ্যমে একজন মানুষকে পরিশুদ্ধ করে উত্তম চরিত্রের অধিকারী করেছেন। হযরত মুহাম্মাদ (স.) এর শান্তির ইসলাম গ্রহণ করে যাবতীয় পাপাচার হতে বিরত থেকে মহান রাব্বুল আলামীনের সাক্ষাত লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। হেদায়েতের এই ধারা বেলায়েতের যুগে অলী-আল্লহগণের মাধ্যমে বহমান। নূরে মোহাম্মাদীর সুযোগ্য উত্তরসূরী, সিরাজুম মুনিরার ধারক ও বাহকের সংস্পর্শে এসে ইসলামের সেই হারানো শিক্ষা গ্রহণ করে উত্তম চরিত্র গঠনের মাধ্যমে আল্লাহ ও রাসূল (স.) এর দীদার লাভ করে ইহলৌকিক ও পরলৌকিক শান্তি , মুক্তি ও কল্যাণ লাভ করতে পারে।

মন্তব্য করুন

en_USEnglish