মুসলমান কে এবং শান্তির চরিত্র ধারণ

মুসলমানের আরবী শব্দ মুসলিম যার অর্থ আত্মসমর্পনকারী। মুসলমান বলতে বুঝায় তাদেরকে যারা নিজেদের ইচ্ছাকে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পন করে। যারা আল্লাহকে এক বলে মানে এবং হযরত মুহাম্মদ (স.) কে শেষ নবি ও রাসুল হিসেবে স্বীকার করে তারা মুসলমান।

মহান আল্লাহ্ নির্দেশ করেছেন, ’ইয়া আইয়্যুহাল্লাযীনা আমানুত্তা কুল্লাহা হাক্বক্বা তুক্বাতিহী ওয়ালা তামুতুন্না ইল্লা ওয়া আনতুম মুসলিমুন’।

অর্থাৎ ’হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে যথার্থরূপে ভয় করো, এবং তোমরা আত্মসমর্পনকারী না হয়ে কোন অবস্থাতেই মৃত্যুবরণ করো না’ (সুরা আল-ইমরান ৩: আয়াত ১০২)।

এভাবেই মহান আল্লাহ্ পাক মানুষকে আত্মসমর্পন করে প্রকৃত মুসলমান হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। রাসুল (স.) বলেছেন- ’ততক্ষণ পর্যন্ত একজন ব্যক্তি মুমিন হতে পারবেনা, যতক্ষণ পর্যন্ত সে ধন সম্পদ, পিতা পুত্র এমনকি সকল জিনিষের চেয়েও আমাকে বেশি ভালো না বাসবে’ (বোখারী ও মুসলিম শরীফ)। সেজন্য মহান আল্লাহর নির্দেশনা ও রাসুল (স.) এর বাণী মোবারকের আলোকে একজন মুসলমানকে আল্লাহ্ তায়ালার প্রতি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস স্থাপন করে তাঁর নিকট পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পন করতে হয়। বিনা দ্বিধায় তাঁর যাবতীয় আদেশ নিষেধের আনুগত্য করে তাঁর দেয়া বিধান ও হযরত মুহাম্মদ (স.) এর দেখানো পথ অনুসারে জীবন পরিচালনা করতে হয়। প্রকৃত মুসলমান যেহেতু মহান আল্লাহর নিকট সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পন করেন সেহেতু মহান আল্লাহও প্রকৃত মুসলমানের জীবনের সব দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ইহকাল ও পরকালে তার আর কোন চিন্তা থাকেনা। তিনি চরম শান্তিতে বসবাস করেন।

এখন দেখা যাক শান্তি কি, চরিত্র কি আর শান্তির চরিত্র ধারণই বা কি। শান্তি বলতে পারস্পারিক ঐক্য, শান্ত অবস্থা বা কোন কিছুর দ্বারা স্বাভাবিক অবস্থা বিঘ্নিত না হওয়াকে বুঝায়। প্রকৃতপক্ষে, শান্তি হলো মানুষের মনের পরিতৃপ্তি যা ব্যক্তির ভিতর থেকে আসে। এটি মানুষের একটি আধ্যাত্মিক অবস্থা যা মানুষ নিজকে শুদ্ধ করার মাধ্যমে অর্জন করে। মহান আল্লাহ্ এবং রাসুল (স.) এর সাথে যার আত্মিক যোগাযোগ থাকে তিনিই পরম শান্তি অনুভব করেন এবং জগতের জন্য শান্তির ফল্গুধারা হিসেবে কাজ করেন। চরিত্র বলতে বুঝায় আচরণের রীতি-নীতির সমষ্টি, যা মানু ষের আচরণকে নিয়ন্ত্রিত ও সংহত করে। এটি মানব মনে প্রোথিত একটি স্থায়ী গুণ, আচার আচরণে যার প্রভাব পড়ে। সে বিবেচনায় মহান আল্লাহ্ ও রাসুল (স.) এর সকল আদেশ নিষেধ মেনে চলার মাধ্যমে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে শান্তির নিয়ামক হিসেবে কাজ করাই প্রকৃতপক্ষে শান্তির চরিত্র ধারণ। আমাদের প্রিয় নবি হযরত মুহাম্মদ (স.) কে মহান আল্লাহ্ পৃথিবীতে শান্তির দূত হিসেবে প্রেরণ করেছিলেন। তিনি মহান আল্লাহর নির্দেশ মতো চলে প্রকৃত শান্তির চরিত্রের অধিকারি হয়েছিলেন। তাঁর দেখানো পথে চলে একজন মুসলমান শান্তির চরিত্র ধারণ করতে পারেন।

এখন প্রশ্ন হলো শান্তির চরিত্র ধারণের প্রয়োজনীয়তা কি। চরিত্র মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ। একজন পরিপূর্ণ মুমিনের পরিচয় হলো শান্তির চরিত্রের অধিকারি হওয়া। প্রতিটি মানুষকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে হলে, তাকে অবশ্যই শান্তির চরিত্রের অধিকারি হতে হবে। সেজন্য যিনি শান্তির চরিত্র ধারণ করতে পেরেছেন তিনিই সফল। মুসলিম শব্দটি সালাম শব্দ থেকে উৎপত্তি যার শাব্দিক অর্থ শান্তি ও নিরাপত্তা বিধান করা।

মুসলমান শব্দেরও আরেকটি অর্থ শান্তিতে বসবাসকারি। কাজেই প্রকৃত মুসলমান ঐ ব্যক্তি, যে নিজে শান্তিতে বসবাস করে, এবং অপরকে শান্তিতে বসবাস করতে দেয়। প্রকৃত মুসলমান কখনো কারো কষ্টের কারণ হয়না। রাসুল (স.) বলেছেন, ’মুসলমান হলো ঐ ব্যক্তি যার হাত ও মুখের অনিষ্ঠতা ও কষ্ট দেওয়া হতে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে’। তিনি আরো বলেন, ’তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি উত্তম চরিত্রের অধিকারি কিয়ামতের দিন সে হবে আমার কাছে অধিক প্রিয় ও নিকটবর্তী’ (তিরমিজি শরীফ)। কাজেই মুসলমান হয়ে মুক্তি পেতে হলে শান্তির চরিত্র ধারণ করতেই হবে।

মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব। এ হিসেবে মানুষের চরিত্র, বৈশিষ্ট ও কর্মকাণ্ড সবই উন্নত ও সর্বোত্তম হওয়া উচিৎ। পশুর ন্যায় কাজকর্ম ও লোভ-লালসা মানবিকতার আদর্শ নয়। যদি কোন মানুষ মানবিকতার আদর্শ থেকে দূরে সরে গিয়ে পশুর ন্যায় আচরণ করে তবে সে মানুষের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বকে ভুলুন্ঠিত করে। শান্তির চরিত্র ধারণ ছাড়া আল্লাহর বিচারে ছাড়া পাওয়ার কোন উপায় নাই। সুফী স্কলার হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা (র.) বলেন, ’শান্তির চরিত্র ধারণ ছাড়া ধর্মে প্রবেশের কোন সুযোগ নাই।

শান্তির চরিত্রের তোরণ দিয়েই ধর্মে প্রবেশ করতে হয়’। তিনি আরো বলেন, ’মানুষের মৃত্যু কালে তিনটি প্রশ্ন করা হবে, তন্মধ্যে একটি প্রশ্ন থাকবে তোমার ধর্ম কি। এখানে ধর্ম বলতে সে ব্যক্তি কি শান্তির চরিত্র নাকি অশান্তির চরিত্র ধারণ করে ধর্ম করেছিলেন তাকেই বুঝানো হয়েছে। শান্তির চরিত্র ধারণ করতে না পারলে সে জবাব দেওয়া সম্ভব হবেনা। মুক্তি পেতে হলে শান্তির চরিত্র ধারণ করতেই হবে।

পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ এরশাদ করেন- ’হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি একজন পুরুষ ও একজন স্ত্রীলোক থেকে এবং তোমাদেরকে পরিনত করেছি বিভিন্ন জাতিতে ও বিভিন্ন গোত্রে, যেন তোমরা পরষ্পরকে চিনতে পারো’ (সুরা আল হুজুরাত ৪৯: আয়াত ১৩)। মহান রাব্বুল আলামিনের এ বাণী মোবারকে সুষ্পষ্ট যে, মানুষ সামাজিক জীব। তারা একে অপরের সাথে পরিচিত হবে এবং একে অন্যের কল্যাণ সাধন ও উপকার করবে। এভাবে তাদের শান্তির চরিত্র দিয়ে একটি শান্তির সমাজ বিনির্মাণ হবে।

একজন মুসলমান নিজের জন্য যা ভালোবাসে অন্যের জন্যও তা ভালোবাসবে আর নিজের জন্য যা অপছন্দের অন্যের জন্যও তা পরিহার করবে এটাই ধর্মের আদর্শ। সবার প্রতি দয়াশীল হওয়া, ছোটদের স্নেহ এবং বড়দের শ্রদ্ধা করা, তাদের দু:খে দু:খি হওয়া এবং তাদের খুশিতে খুশি হওয়া মুসলমানের জন্য অপরিহার্য।

এসবই শান্তির চরিত্রের অনুশীলন।

পৃথিবীতে সবাই শান্তি খুঁজে। এখন দেখা যাক শান্তির চরিত্র অর্জন করতে হলে কি করতে হবে। একমাত্র আল্লাহই হচ্ছেন শান্তির উৎস। সুরা রাদের ২৮ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ’আল্লাহর স্মরণ দ্বারাই অন্তরসমুহ প্রশান্ত হয়’। সুফী স্কলারদের মতে, ’শান্তি পেতে হলে রাসুল (স.) এর চরিত্র ধারণ করতে হবে’। রাসুল (স.) ছিলেন অসীম শান্তির চরিত্রের ধারক ও বাহক। তিনিই অনুসরণীয়। তাঁর সম্পর্কে আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, ’তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ (সুরা আল আযহাব ৩৩: আয়াত ২১)।

মহান আল্লাহ্ আরো বলেন, ’নিশ্চয় তিনি মহান চরিত্রের অধিকারি (সুরা আল কালাম ৬৮: আয়াত ৪)। কাজেই রাসুল (স.) এর চরিত্রের দিকগুলো অনুসরণ করে মহান আল্লাহকে স্মরণ করার মাধ্যমেই শান্তির চরিত্র অর্জনের পথে আগানো যায়।

মানুষ কাম রিপুর কুপ্রভাবে তাড়িত হয়ে ব্যাভিচারে লিপ্ত হয়। ক্রোধ রিপুর কারণে মারামারি, হানাহানি, রক্তপাত ও হত্যাযজ্ঞ ঘটে।

লোভে লিপ্ত হয়ে চুরি, ডাকাতি ও দূর্নীতি করে। মোহে পড়ে প্রতিপত্তি, ক্ষমতার জন্য ব্যাকুলতা, মুর্খতা ও বিবেকশুণ্যতায় পতিত হয়। মদ রিপুর প্রভাবে ধরাকে শরা জ্ঞান করে। মাৎসর্য রিপু ঈর্ষা, হিংসা ও পরশ্রীকাতরতার প্রবৃত্তির উদ্রেক করে। নিজের স্বার্থ বৈ অন্যের সমৃদ্ধিকে সহ্য করতে পারেনা।

এসবই শয়তানের প্ররোচনায় ঘটে। সেজন্য মানুষকে শয়তানের প্ররোচনা থেকে মুক্ত হয়ে শান্তির চরিত্র ধারণ করতে হয়। সাধনার মাধ্যমে শিখতে হয় কিভাবে শয়তানের প্ররোচনাকে এড়িয়ে চলা যায়। নবী রাসুলের আগমন ও আসমানি কিতাবের মূল লক্ষ্যই ছিল মানুষের সমাজে প্রকৃত শান্তি, কল্যাণ এবং ইনসাফ নিশ্চিত করা। সর্বশেষ কিতাব আল কুরআন নাজিলের চুড়ান্ত লক্ষ্য এ সকল বিধানকে পূর্ণতা দেওয়া।

জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য সামাজিক ন্যায় বিচার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই ধর্মের মূল লক্ষ্য। রাসুল (স.) বলেন, ’সব বিশ্বাসী মানুষ এক দেহসম। দেহের যে কোনো যায়গায় ব্যথা পেলে চোখে পানি আসে, সারা শরীরে জ্বর আসে’ (বুখারি ও মুসলিম শরীফ)। রাসুল (স.) এর নির্দেশনা মোতাবেক এমন দর্শন অন্তরে ধারণ করে চলতে পারলে তিনিই হয়ে উঠতে পারেন শান্তির চরিত্রের ধারক।

আল্লাহর রাসুল (স.) এরশাদ করেন ’হে আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা যেহেতু পরষ্পর ভাই ভাই সেহেতু এক মুসলমান অন্য মুসলমানের আপনজন। সুতরাং এক ভাই তার অন্য ভাইকে নির্যাতন করতে পারেনা, হেয় প্রতিপন্ন করতে পারেনা এবং অপমানিত অপদস্থও করতে পারে না’ (মুসলিম শরীফ)। রাসুল (স.) ফরমান ’ইরহাম মান ফিল আবদি ইয়ারহামুকুম মান ফিস সামায়ি।’ অর্থাৎ তোমরা যদি সৃষ্টিকে ভালোবাস, তাহলে উর্ধ্বলোকের অধিপতি (আল্লাহ্) তোমাদেরকে ভালবাসবেন।

সৃষ্টির প্রতি বিশ্বনবীর ভালোবাসার এ আহ্বান মেনে চলতে পারলেই আমাদের জীবনে শান্তির চরিত্র ধরা দিবে।

যখন আমাদের মাঝে আহম্মদি চরিত্র প্রকাশ পাবে এবং হযরত রাসুল (স.) এর কথা আমরা স্মরণ করব তখনই অন্তরে ইমানের নূর সৃষ্টি হবে। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে-’যে ব্যক্তি রাসুলের আনুগত্য করে, সেতো আল্লাহরই আনগত্য করল (সুরা নিসা ৪: আয়াত ৮০)। রাসুল (স.) এর চিন্তা-চেতনা, মনমানসিকতা, কথা-বার্তা, আচার-আচরণ, রীতি-নীতি সবই ছিল অপুর্ব সুন্দর সুসমণ্ডিত। তিনি মানব জাতিকে দিয়ে গেছেন সর্বোত্তম জীবন বিধান। রাসুল (স.) বলেন- ’যে ব্যক্তি আমাকে ভালোবাসল, সে জান্নাতে আমার সঙ্গে অবস্থান করবে’ (তিরমিজি শরিফ)। তিনি আরো বলেছেন, ’চরিত্রের বিচারে যে লোকটি উত্তম, মুমিনদের মধ্যে সেই পূর্ণ ইমানের অধিকারি’ (তিরমিজি শরিফ)। আরো এসেছে, ’তোমাদের মধ্যে সেই লোকটিই আমার নিকট অধিক প্রিয়, যার নৈতিক চরিত্র সবচেয়ে সুন্দর’ (বুখারি শরিফ)।

সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহবুব এ খোদা (র.) মানুষের চরিত্র সংশোধনের মাধ্যমে শান্তি ও সমৃদ্ধির চরিত্র অর্জনের তাগিদ দিয়েছেন। তিনি বলে গেছেন, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রকৃত শান্তি বাস্তবে পেতে হলে রাসুল (স.) এর চরিত্রে চরিত্রবান হতে হবে। মানুষ যখন নফ্স তথা জীবাত্মার তাড়নায় পরিচালিত না হয়ে, আল্লাহর নির্দেশিত পথে নিজকে পরিচালিত করবে, তখন স্বাভাবিক নিয়মেই শান্তি লাভ করবে। যে কারণে অশেষ দয়াময় আল্লাহ্ তাঁর বান্দারের নির্দেশ করেছেন, ’ইয়া আইয়্যুহাল্লাযীনা আমানুদ খুলু ফিস সিলমি কাফফাতান, ওয়ালা তাত্তাবিউ খুতুওয়াতিশ শাইত্বানি, ইন্নাহু লাকুম আদুওউম মুবীন।’ অর্থাৎ হে মুমিনগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করো, এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু’ (সুরা আল-বাকারাহ ২: আয়াত ২০৮)। সৃষ্টির আদিকাল থেকে মহিমান্বিত আল্লাহ্ একে একে নবি ও রাসুলদের প্রেরণ করেছেন, যেন এ সকল মহামানব সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহর শান্তির বিধান প্রচার করেন, এবং মানুষের অন্তরে শান্তি পৌঁছে দিয়ে মহান প্রভুই যে শান্তির উৎস তা উপলদ্ধি করার সুযোগ করে দেন। এরই ধারাবাহিকতায় মহান আল্লাহ্ নবুয়ত পরবর্তী বেলায়েতের যুগে যুগের ইমাম, মোজাদ্দেদ ও আওয়িায়ে কেরামকে প্রেরণ করে, মুক্তিকামী মানুষকে শান্তি উপলদ্ধি করার সুযোগ করে দেন। প্রকৃতপক্ষে অন্ধকার রাতে যে ব্যক্তির কাছে জ্বালানো বাতি রয়েছে, তার কাছে গেলে যেমন আলো পাওয়া যায়, তেমনি পথভ্রষ্টতার অন্ধকারে নিমজ্জিত এবং ষড়রিপুর বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে অশান্তির জাঁতাকলে পিষ্ট মানুষ যখন শান্তির দূত মহামানবের সোহবত লাভ করে, তখন সে শান্তির সন্ধান পেয়ে যায়। তার আমিত্ব দূর হয়ে যায়। সাধনার মাধ্যমে সে হয়ে উঠে শান্তির চরিত্রের অধিকারি।

আজকের সমাজের মানুষ শান্তির অন্বেশায় আপ্রাণ চেষ্টা করছে বটে, কিন্ত তারা অশান্তির হাত থেকে নিস্কৃতি পাচ্ছে না। এর মূল কারণ আল্লাহ্ থেকে বিমুখ হওয়া এবং আল্লাহর দেয়া বিধান থেকে বিচ্যুত হওয়া। মানুষ ষড়রিপুর তাড়নায় আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পনের পরিবর্তে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। তারা আল্লাহর দেয়া পথকে উপেক্ষা করে মনগড়া মতবাদের সৃষ্টি করে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। মানুষের এ প্রচেষ্টায় আত্মকলহ, সংঘাত ও পারষ্পারিক হানাহানির সৃষ্টি হচ্ছে। মানুষ নিজেদের ক্রিয়াকর্মের ফলেই আল্লাহ্ প্রদত্ত স্বর্গীয় শান্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শান্তির চরিত্র হারিয়ে ফেলছে।

এখন প্রশ্ন আসে কিভাবে আল্লাহ্ ও রাসুল (স.) এর নির্দেশনা মোতাবেক শান্তির চরিত্র অর্জন করা যায়।

কেবলমাত্র আত্মশুদ্ধির মাধ্যমেই নিজের ভিতরের খারাপি দূর করে শান্তির চরিত্র ধারণ করা সম্ভব। আত্ম অর্থ নিজ, নফস্ বা জীবাত্মা। আর শুদ্ধি অর্থ পবিত্রকরণ। সুতরাং আত্মশুদ্ধি অর্থ নিজের নফ্স বা জীবাত্মাকে পরিশুদ্ধ করা। আত্মশুদ্ধির মর্ম হচ্ছে নিজের নফ্সকে ষড়রিপুর বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে নিজেকে পরিশুদ্ধ করা। মহান আল্লাহ্ নিজেই বলেন, ’নিশ্চয় সাফল্য লাভ করবে সে, যে আত্মশুদ্ধি লাভ করে’। (সুরা আলআলা ৮৭: আয়াত ১৪)। মহান আল্লাহ অন্যত্র এরশাদ করেন, ’অবশ্যই সফলকাম হয়েছে সে ব্যক্তি, যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করেছে। আর ব্যর্থ হয়েছে সে ব্যক্তি, যে নিজেকে পাপাচারে কলুষিত করেছে’। (সুরা আশশামস ৯১: আয়াত ৯-১০)। কুল-কায়েনাতের রহমত বিশ্বনবি হযরত মুহাম্মদ (স.) বর্বর আরব জাতিকে আত্মশুদ্ধির এ সুমহান শিক্ষা দিয়েই আদর্শ চরিত্রবান রূপে গড়ে তুলেন এবং বিশ্ববাসির জন্য অনুসরণীয়, পরিশুদ্ধ এক মানব সভ্যতা বিনির্মাণ করেন। বর্তমানে রাসুল (স.) এর কাজ করছেন সত্যাশ্রয়ী কামেল অলিআল্লাহগণ। এসব সত্যাশ্রয়ী অলি আল্লাহদের সঙ্গ লাভ করার জন্য মহান আল্লাহ্ নির্দেশ দিয়েছেন। সে মোতাবেক তাঁদের নির্দেশমত আমল করে দয়াল রাসুল (স.) এর পথে চলা সম্ভব। তাদের দেখানো পথে মোরাকাবা করে সাধনার মাধ্যমে শান্তির চরিত্র ধারণ করা যায়।

শয়তান মানুষের ক্বাল্বে অবস্থান করে। যখন ক্বাল্বে জ্বিকির জারি হয়, শয়তান তখন সরে যায়। এভাবে ক্বাল্ব পরিশুদ্ধতা লাভ করে। আর ক্বাল্ব শুদ্ধ হলে সমস্ত শরীরই শুদ্ধ হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে কুরিপুসমুহ আত্মার জীব প্রবৃত্তিকে শক্তিশালী করে মানুষকে অশান্তির চরিত্রে চালিত করে। সেজন্য শান্তির চরিত্র অর্জনের জন্য আত্মাকে অবশ্যই শুদ্ধ বা কুরিপু মুক্ত করা প্রয়োজন। আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পনের প্রথম শর্ত আত্মাকে কুরিপু মুক্ত হওয়া। এ উদ্দেশে সমকালীন যুগের মহামানবের সোহবতে এসে সাধনা করতে হয়।

আসুন আমরা বেলায়েতের এ যুগে অলি আল্লাহদের সোহবতে এসে মহান আল্লাহ্ ও রাসুল (স.) এর নির্দেশিত পথে চলে এবং সাধনা করে আত্মশুদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে প্রকৃত মুসলমান হয়ে শান্তির চরিত্র ধারণ করি। শান্তির পথে জীবন পরিচালনার মাধ্যমে ইহকালের শান্তি এবং পরকালের মুক্তি অর্জন করে মানব জীবন সফল করি। মহান আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে সে তৌফিক দান করুন। আমিন----।

মন্তব্য করুন

en_USEnglish